জন্মান্তর
-পার্থসারথি ঘোষাল
[বিঃদ্রঃ-এই গল্পের সমস্ত চরিত্র ও ঘটনাবলী সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক।বাস্তবের সঙ্গে যদি কোনো যোগ থেকে থাকে তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত ও সম্পূর্ণ রূপে কাকতালীয়।]
মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি অজানাকে জানা, এই প্রবৃত্তি মানুষকে অনেক সময় নেশার মতো পেয়ে বসে।ইন্দ্রজিৎ বাবুরও প্রায় সেই রকম অবস্থাই হয়েছিল।ইন্দ্রজিৎ বাবু –মানে ডঃ ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ী। ভদ্রলোক কোলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজের জীববিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে অনেক নিগূঢ় অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। অবসর গ্রহণের পর তিনি চলে এসেছিলেন মেদিনীপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটে পালপাড়ায়। তিনি বিপত্নীক, অবশ্য তাঁর দুই ছেলে আছে, তারা দু’জনেই উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী–যে যার ফ্যামিলি নিয়ে ভিনরাজ্যে বাস করে। মাঝে সাঝে অবশ্য তারা যে বাবার খবর নিতে গ্রামের বাড়িতে আসে না –তা কিন্তু নয়; তবে তা খুবই বিরল। ইন্দ্রজিৎ বাবুর বয়স প্রায় সত্তর বছর; কিন্তু তাই বলে স্বাস্থ্য সেই অনুপাতে ভেঙে যায় নি। এ বয়সেও তিনি রীতিমতো ড্রিঙ্ক করেন তবে সবই বিদেশী জিনিস। আজকাল তাঁকে বাইরেও খুব একটা দেখা যায় না। এখানে ত়াঁর সঙ্গী বলতে রাঁধুনি হরি, আর ফাইফরমাস খাটার জন্য এই গ্রামেরই ছেলে–গজা এবং তাঁর অতি আদরের স্যামসন্(ডোবারমেন্ট)। বাড়িটা একটা বহুকক্ষবিশিষ্ট দোতালা বাড়ি। গ্রাউন্ডফ্লোরে ঠিক মাঝখানে চৌকো বারান্দা এবং তার চারপাশে কিচেন ও ভাঁড়ারের জন্য ব্যবহৃত দু’টি রুম, তাছাড়াও রয়েছে অ্যাটাচ্ বাথ দু’টি টয়লেট। একটা ঘর রাঁধুনি হরির জন্য বরাদ্দ, এবং আরও গোটা তিনেক ঘর যেগুলো সবই বর্তমানে আন্ডার লক্ অ্যান্ড্ কি। দোতালার যে ঘরে ইন্দ্রজিৎ বাবু থাকেন তার গায়েই বাথরুম ও টয়লেট। তাছাড়াও রয়েছে বারান্দা ও বারান্দার চারপাশে লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরি রুম, এবং আরোও গোটা তিনেক ঘর ও একটা মাঝারি সাইজের বাথরুম কাম টয়লেট যেগুলো তালা বন্ধই থাকে প্রায়। গ্রাউন্ডফ্লোরে যাওয়ার সিঁড়ির দরজা বারান্দার একদিকে তাতে দামী ভেলভেটের পর্দা ঝুলছে। বাড়ির চারধারে প্রায় আটফুট উঁচু সারাউন্ডিং ওয়াল। প্রায় বিঘে তিনেক জায়গার উপর এই বাড়ি ও বাড়ি সংলগ্ন একটা বাগান যেখানে দেশী বিদেশী সব গাছই চোখে পড়বে। বাগানটা অবশ্য বাড়ির পেছনে, গ্রাউন্ডফ্লোরের একটা মাঝারি গেট দিয়ে ঐ বাগানে যাওয়া আসা করা যায়। অবশ্য, অন্য আর একটা পথও রয়েছে বাগানে যাবার– সেটা হলো বাড়ির ডানপাশে যে লম্বা পার্টিশন্ ওয়াল, বাগান এবং বাড়ির সম্মুখস্থ লন ও ফুলের বাগিচাকে পৃথক করেছে–তার গায়ে একটা ছোটো দরজা আছে। বাড়ির বামদিকে আরও একটা পার্টিশন্ ওয়াল রয়েছে তবে তা নাতিদীর্ঘ। অর্থাৎ বাড়িটা পুরো জায়গাটার মোটামুটি মাঝে। বাড়ির সামনে একদম ফটক পর্যন্ত প্রশস্ত লন, তার দু’পাশে গার্ড ওয়াল দিয়ে তৈরী ফুলের বাগিচা, কারণ ইন্দ্রজিৎ বাবু ফুল খুব ভালোবাসেন।বাড়ির কিচেন রুম সংলগ্ন একটা ইঁদারা, তাতে দামী পাম্পবসানো। দোতালার ছাদে একটা জাহাজ মার্কা জলের ট্যাঙ্ক। মোটকথা আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত হাউসিং পরিকাঠামোর প্রসাদ থেকে এ বাড়ির পরিবেশ যে বঞ্চিত নয়, তা সহজেই অনুমেয়। একটা দারোয়ান এবং দামী গাড়ির বোধহয় প্রয়োজন ছিল তবে কি কারণে যে এ দু’টি অনুপস্থিত তা বোঝা বড় শক্ত।
আজ থেকে পাঁচ/ছয় বছর আগে ইন্দ্রজিৎ বাবুর কথায়-বার্তায় একটা প্রাণবন্ত মিশুকে ভাব লক্ষ্য করা যেত। বর্তমানে কি যেন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি যেন একটু অস্বাভাবিক মাত্রায় চুপচাপ; কারণ ছাড়া কথা বলেন না –এই আর কি! খুব ভোরে একবার দোতালা থেকে লনে একটু যা পাইচারি করেন, বাদবাকি দিনের অধিকাংশ সময়েই তিনি লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে কি যেন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে–তাঁর কাছে মাঝে মাঝে কোলকাতা থেকে এক ভদ্রলোক আসেন। একদিন থেকে, তারপরের দিনই আবার ফিরে যান। ভদ্রলোকের নাম রমেন পুরকায়স্থ, জানা যায় উনিও নাকি ঐ সুরেন্দ্রনাথ কলেজেই ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করতেন। তিনিও রিটায়ার করেছেন আজ বছর ছয়েক হলো।
একদিন ল্যাবরেটরি রুমের সামনে ইন্দ্রজিৎ বাবুকে খুব চিন্তিত মনে হলো, হঠাৎ তিনি লাইব্রেরী রুমে ঢুকে টেলিফোনে কাকে যেন রিং করে বললেন, “হ্যালো, বিভাস আমি স্যার বলছি। আমার একটা বিষয় তোমার কাছে জানার ছিলো–হ্যাঁ, আরে না না–আজকাল আর চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগাতে পারছি না।” টেলিফোনের ওপারে যিনি রয়েছেন অর্থাৎ বিভাস নামে লোকটি ব্যাপারটা মনে হয় জানতে চাইলো।ইন্দ্রজিৎ বাবু তখন তাকে যা বললেন তার মর্মার্থ হলো —-মানুষ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কি কোনো অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ করে, এবং সেখান থেকে একটা নৈসর্গিক শক্তি মাধ্যমে ইহজগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে আবার পুনর্জন্ম লাভ করতে সমর্থ হয়? কিছুক্ষণ ধরে তিনি রিসিভারে কান রেখে খুব অভিনিবেশ সহকারে ঐ বিভাস নামে লোকটির কথা শুনলেন এবং অবশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। তাঁর চোখ মুখের ভাব দেখে মনে হলো তিনি যেন তাঁর কাঙ্খিত জবাব পেলেন না। রুম থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলেন নীচে ,সঙ্গে তার একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু স্যামসন্। হরির তাঁর উপর চোখ পড়তেই বললো, “বাবু,আপনি এইসময় নীচে? কি মনে করে?” ইন্দ্রজিৎ বাবু যেন কথাটা শুনতেই পেলেন না মনে হলো। ঘড়িতে তখন প্রায় বিকাল সাড়ে পাঁচটা। স্যামসন প্রাচীরে হনুমানের মতো কি একটা দেখে বাঘের মতো গর্জন করতে লাগলো, ইন্দ্রজিৎ বাবু তাকে শান্ত করলেন। হরি খানিকটা দ্রুত ওদিকে এগিয়ে গিয়ে হাত উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,”হেই-হেই–যা-যা-যা-হুস্-হুস্-যা-যা।”প্রাচীরে বসে থাকা প্রাণীটি হরির ঐ অদ্ভুত আওয়াজে ভয় পেয়ে, সেখান থেকে বোধহয় পালিয়েই গেলো। ইন্দ্রজিৎবাবু স্যামসনকে মুখে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করে হাত ইশারা করা মাত্র সে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো একেবারে দোতালায়।
এবার হরির দিকে মুখ ফিরিয়ে ইন্দ্রজিৎ বাবু বললেন,”আচ্ছা হরি ,মানুষ মরলে কোথায় যায় জানিস্?” হরি মুখটা একবার আকাশের দিকে তুলে কি যেন ভেবে নিয়ে বললো,”সে তো জানিনা বাবু,তবে বাপ ঠাকুরদার মুখে শুনেছি ভাল কর্ম করলে স্বর্গ লাভ হয় আর কুকর্ম করলে নরকে পচে মরতে হয়।”
ইন্দ্রজিৎ বাবু বুঝতে পারলেন যে হরির লেখাপড়া যা একটু আছে সেইটুকুই যথাসম্ভব কাজে লাগিয়ে সে একটা তার মতো করে জবাব দিয়েছে ,এর বেশী আশা করা বোধহয় বাতুলতা; তাই কি যেন ভেবে একটু মৃদু হেসে চলে গেলেন ফুলের বাগিচার কাছে এবং ফুলের গাছগুলো পরীক্ষা করতে করতে হাঁক পাড়লেন,”গ-জা-জা-জা,এই গ-জা— কোথায় গেলি রে বদমাইশ?”
হরি জানালো, “বাবু ,গজা আজ খেয়ে দেয়ে বিদেয় নিয়েছে। আজ পাশের গ্রামে পঞ্চরস দেখতে যাবে।আজ আর ও আসবে না, আবার কাল সেই সকাল আটটা না নটা! তার ঠিক ঠাহর নাই।”
ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”কাল গজা এলে গাছগুলোতে জল দিতে বলবি, জলের অভাব হয়েছে মনে হচ্ছে।”
হরি সম্মতি সূচক ঘাড়টা একবার ডানদিকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এঙ্গেলে নুইয়ে দ্রুত চলে গেলো পেছনের বাগানে। ইন্দ্রজিৎ বাবুও ততক্ষণে পায়ে পায়ে উঠে এলেন দোতালার লাইব্রেরী রুমে। টেবিলের উপর তখনও একটা বই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে–বইটা আসলে হেনরী গ্রে’র লেখা– একটা হিউম্যান অ্যানাটমির বই। সেই বইটার একটা পাতার কতকগুলো লাইনকে ইন্দ্রজিৎ বাবু লাল কালি দিয়ে ভালোভাবে আন্ডার লাইন করে মনে হয় আবার পরবর্তী অংশে মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর বই থেকে মুখ তুলে চেয়ারে শরীর এলিয়ে লাইব্রেরী রুমের চারদিকে একবার চোখ বোলাতে লাগলেন।
লাইব্রেরী রুমের চারটে কাঠের আলমারীতে দেশী বিদেশী অসংখ্য দামী দামী বই। ঘরের মাঝখানে একটা সেক্রেটারিয়েট গোছের টেবিল। টেবিলের একপাশে দরজার দিকে মুখ করে একখানা দামী রিভলভিং চেয়ার ও আর একপাশে খানচারেক কাঠের বার্ণিশ করা চেয়ার। ঘরটার একদিকে অর্থাৎ বাগানের দিকটায় দু’টো বেশ বড় মাপের জানালা, তাতে দামী সবুজ কাঁচ লাগানো। ঘরটায় আপদকালীন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও রয়েছে।এই লাইব্রেরি রুমেই ইন্দ্রজিৎ বাবু অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন।
এবার একটু ল্যাবেরেটরি রুমে উঁকি মারা যাক–দুটো স্টিলের বড় সাইজের আলমারী–তালা বন্ধ মনে হয়।
এককোণে একটা নরকঙ্কাল—আসল না নকল তা দুর থেকে কিছুই বোঝা যায়না। তিনটে টেবিল পর পর সাজানো —তাতে দু’ তিনটে মাইক্রোস্কোপ বেশ দামী বলেই মনে হয়। একটা ট্রেতে কিছু ছুরি ও কাঁচি। একটা কোণে একটা ডাস্টবিন; তাছাড়াও দেওয়ালের চারদিকে নানা ধরণের গাছ গাছালি ও বিভিন্ন জীবজন্তুর লেমিনেটেড করা ছবি, সেখানে মানব দেহের ছবিও রয়েছে বেশ কয়েকটি। আলমারীর মাথায় রয়েছে ফাইলের পাহাড় কতদিনকার যে পুরনো তা বাইরে থেকে দেখে আন্দাজ করে ওঠা মুশকিল।কিন্তু একটা জিনিস দেখে একটু অবাকই হতে হয়, আর তা হলো দেওয়ালের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে টাঙানো একটা বড় পঞ্চকোণের ছবি। অবশ্য এই রকম আর একটা ছবিও চোখে পড়বে লাইব্রেরি রুমের দেওয়ালে রিভলভিং চেয়াটার সামনাসামনি দরজার ঠিক উপরের দেওয়ালে—এতক্ষণে ইন্দ্রজিৎ বাবুর চিন্তা বিহ্বল মানসিকতার মোটামুটি একটা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে—-আজকাল তিনি বিজ্ঞানের চর্চা থেকে খানিকটা সরে এসে তারই পরিপূরক হিসাবে হয়ত আর একটা বিষয়েও চর্চা ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন আর তা হলো নেক্রোমেন্সি(কালাজাদু)ও ব্ল্যাকমাস(ডাকিনীবিদ্যা) নিয়ে খুব গভীর পড়াশোনা এবং হাতেকলমে এই গুপ্তবিদ্যার সত্যতা যাচাই করে নেওয়া। এবং মোটামুটি আন্দাজ করা যায় যে হয়ত এই কারণেই কোনো কোনোদিন গভীর রাত্রে ল্যাবেরেটরির দরজা বন্ধ করে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তবে ব্যাপারটা যে কি তা কারও পক্ষেই জানা বোধহয় সম্ভব নয়, একমাত্র হরি ছাড়া-তবে হরিকে দেখেও মনে হয়না যে, সে ঘটনাটা সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানে!
ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকলেই একটা পচা গন্ধের অস্তিত্ব একটু গভীর ভাবে নিঃশ্বাস নিলেই টের পাওয়া যায়।এর থেকে মোটামুটি এমনটাই অনুমান করা যেতে পারে যে ইন্দ্রজিৎ বাবু এখানে জীবিত অথবা সদ্যমৃত জীবজন্তুর দেহ কাটাছেঁড়া করেন এবং এইজন্যই টেবিলের উপর ট্রেতে দেখা গেল ছুরি কাঁচির উপস্থিতি–এবং সেইসব মৃতদেহের রক্ত ও মেদের অবশিষ্টাংশ পরিস্কার করে কোণের ঐ ডাস্টবিনে ফেলা হয়। হতে পারে এ গন্ধের উৎস সেখানেই। তবে সেইসব মৃতদেহ গুলি যে কোথায় ফেলা হয় তা অজ্ঞাত। হঠাৎ শোনা গেল কার যেন পায়ের শব্দ, চারদিকে তখন রীতিমতো অন্ধকার নেমেছে। দেখা গেলো ইন্দ্রজিৎ বাবু ল্যাবরেটরি রুমে সন্তর্পণে ঢুকলেন এবং দরজা বন্ধ করে একটা মৃদু আলো জ্বালালেন, মৃদু নীলচে আলোয় ঘরটার চারদিক একটা অতিপ্রাকৃত অবয়ব গ্রহণ করলো–ইন্দ্রজিৎবাবু দেওয়ালের ঐ পঞ্চকোণের (কালাজাদুর প্রতীক) ছবিটাকে একটা টৈবিলের উপর রাখলেন ও তারপর আলমারী খুলে কালো কাপড়ে জড়ানো মূর্তি জাতীয় কিছু একটা জিনিস বার করে আনলেন। এখন দেখা যাচ্ছে তিনি ঐ মূর্তিটা কোলে নিয়ে বসলেন ছবির সামনে চেয়ারে। তাঁর ঠোঁট দুটোর মধ্যে খুব মৃদু আন্দোলন।এই অবস্থায় তিনি চোখ বুঝে প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধ্যানস্থ হয়ে রইলেন, কিন্তু তাঁর ধ্যানে হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটালো বাইরে স্যামসনের একটানা গম্ভীর –হাউ–হাউ চিৎকার। ইন্দ্রজিৎ বাবু বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন যে স্যামসন বাগানের দিকে কি যেন একটা দেখে তখনও চিৎকার করেই চলেছে। সাবেকী আমলের ওয়ালক্লক ঢং-ঢং আওয়াজ তুলে জানিয়ে দিলো রাত্রি আটটা। ইন্দ্রজিৎ বাবু স্যামসনকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করলেন; কিন্তু স্যামসন যেন আজ একটু বেশী মাত্রায় সন্দেহতাড়িত হয়ে হিংস্র হয়ে উঠতে চাইছে। ইন্দ্রজিৎ বাবুর চোখে মুখে একটা কুটিল চিন্তা যেন পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করেছে, তিনি একটা বিশেষ কৌশলে স্যামসনের মুখের সামনে হস্তসঞ্চালন করতেই স্যামসন যেন শান্ত হয়ে গেলো।দেখে মনে হলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর সেই বিশেষ কৌশলে হস্তসঞ্চালনার মধ্যে একটা অলৌকিক অথচ নিগুঢ় রহস্যময়তা বিরাজ করছে। আজ থেকে বছর দুয়েক আগে ইন্দ্রজিৎ বাবু প্রায় প্রতিদিন একটা শ্মশানেও নাকি যাতায়াত করতেন,তবে কি জন্য যে তিনি শ্মশানে যেতেন সে কারণ জানা সম্ভব নয়। এখন অবশ্য বেশ কিছুদিন হলো সেই অভ্যাস থেকে তিনি বিরত রয়েছেন। যাইহোক স্যামসনের ঐ ধরণের আচরণে ইন্দজিৎবাবুর চেহারাতেও যেন একটা অস্বাভাবিক শক্তির প্রভাব ক্রমশঃ প্রকট হয়ে উঠছে–যা লক্ষ্য করার মতো।ইন্দ্রজিৎ বাবুর হাবভাব দেখে মনে হলো বাগানের ঐ অন্ধকারেই যেন তাঁর চির আকাঙ্খিত কোনো কিছু তিনি খুঁজে চলেছেন মানসবিহারের মধ্য দিয়ে। হঠাৎ সিঁড়িতে কার যেন পায়ের শব্দ শুনে ইন্দ্রজিৎ বাবু নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। হরিই এতক্ষণ সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠছিলো। ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে দেখে বললেন,”ও! তুই? কিরে কিছু বলবি?”
হরিকে দেখে মনে হলো সে যেন অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখেছে, একটা আতঙ্ক মাখা চোখে চেয়ে রইলো ইন্দ্রজিৎবাবুর মুখের দিকে। ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে জিজ্ঞাসা করলেন “কিরে হরি? কি হলো? আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে কি দেখছিস?”
হরি এবার ঢোক গিলে বললো,”বা-বু, বা-গা-নে সে-ই বি-দে-শী ফু-লগাছ-টার নী-চে?”
“হ্যাঁ, কি হলো সেখানে?”ইন্দ্রজিৎ বাবু জানতে চাইলেন।
হরি বললো,”এক-টা মুর্তি পা থেকে মা-থা প-র্যন্ত মেম-সাহেব-দের মত কালো বোর-খা পরা, হাতে এক-টা জ্ব-লন্ত লো-হার শিকের মত কিছু ছিলো, যার লাল রঙের আ-ভায় দেখ-লাম ঐ মুর্তির মুখটা– কি ভয়ংকর! চোখ ,মুখ,নাক কিচ্ছু নেই যেন একটা এবড়ো খেবড়ো পাথরের বড় টুকরো”
ইন্দজিৎবাবু কৌতূহলী হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন,”তুই ঠিক দেখেছিস?”
হরি আরও জোর দিয়ে বললো,”মা কালীর দিব্যি বলছি বাবু! আমি যা দেখেছি একদম সত্যি, একটুও বাড়িয়ে বলছি না আপনাকে।” ইন্দ্রজিৎ বাবু কথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে যেন খুব উৎসাহ পেলেন এবং মনে মনে ভাবতে লাগলেন,”হুঁ-হুঁ বাবা,এতদিনের সাধনা, না এসে যাবে কোথায়!” এবার হরির পিঠে হাত রেখে বললেন,”বোকা কোথাকার! কি দেখতে কি দেখেছে কে জানে!–ভয় নেই !ভয় নেই! ওসব কিচ্ছু না –তোর চোখের ভুল।”
হরি বললো,”না বাবু চোখের ভুল নয় আমি দেখেছি–আমার খুব ভয় করছে বাবু।”
ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে নিয়ে নিজের বেড রুমে প্রবেশ করলেন। তারপর হরিকে একটা চেয়ারে বসতে বললেন। তিনি নিজে হরির সামনে দাঁড়ানো অবস্থাতেই কাগজে মোড়া কি যেন একটা জিনিষ ড্রয়ার থেকে বের করে হরির আপাদমস্তক কয়েকবার বুলিয়ে তারই কিছুটা অংশ একটা লাল কাপড়ে বেঁধে হরির ডান হাতে বেঁধে দিয়ে বললেন,”যা রে ক্ষ্যাপা তোর আর কোনো ভয় নেই,এই লালকাপড় যতক্ষণ তোর হাতে বাঁধা থাকবে দুনিয়ার কোনো অশুভ শক্তিই তোর চুল স্পর্শ করতে পারবে না। দেখবি এই লাল কাপড় যেন কখনো,কোনো অবস্থাতেই খুলে না যায়?”
হরির মাথাতে বিন্দু বিসর্গ কিছূই ঢুকলো না, শুধু মাথা নেড়ে সেখান থেকে বিদায় নিলো।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে এখন হরির আর তেমন ভয় টয় করে না। হরি মনে মনে একটা বিরাট সাহস পেয়েছে–ঐ যে হাতে তার মন্ত্রপুত লালকাপড়ের টুকরো! হরি সারাদিনে কতবার যে ডানহাতের কনুইয়ের উপর বাঁধা ঐ লাল কাপড়ের টুকরোটি যত্ন সহকারে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখে কে জানে! ওটিই যেন এখন তার প্রাণভমরা। তবে হরির মনে একটা ব্যাপার খুব খচ্ খচ্ করতে লাগলো; আর তা হলো তার মালিক অর্থাৎ ইন্দ্রজিৎ বাবুর উপচিকিৎসাবিদ্যার উপর বিশ্বাস ও তা করায়ত্ত করার রহস্য। কারণ আজ প্রায় ছয়-সাত বছর হলো সে এখানে রাঁধুনির কাজ করে আসছে। বাবুর এ হেন গুণের পরিচয় সে ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন টের পায়নি,আর সেদিনকার মতো অমন অদ্ভুত ঘটনাও ঘটেনি এর আগে কোনোদিন-এতক্ষণ কুয়োর ধারে সুপারি গাছটায় হেলান দিয়ে এইসব কত কি যে সে ভাবতে লাগলো মনে মনে তার ইয়ত্তা নেই। ততক্ষণে গজা যে পা টিপে টিপে তার পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে তা সে টেরও পায়নি।
হঠাৎ গজা বলে উঠলো,”কি গো হরিকা কি ভাবতেছ?কাকীমার কথা বুঝি?”
হরি খেঁকিয়ে উঠে বললো,”দুর হ এখান থেকে!দুর হ! হতভাগা কোথাকার। কথার কেমন ছিরি দেখো?”
গজা চোখ বড় বড় করে বললো,”কাকা, বাগানের বাঁধানো আমগাছে ভুত আছে গো!ভু–ত!”
হরি একবার চারদিক দেখে নিয়ে বললো,”তুই দেখেছিস?”
“দেখেছি মানে! ভুতের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেছি –ভুত আমাকে বলেছে ভর সন্ধ্যাবেলা তার কাছে গেলে সে এমনকি এই ফাগুনমাসেই পাকা আম খাওয়াবে।” কথাটা বলেই গজা হি-হি করে বিচ্ছিরি একটা হাসি হাসতে হাসতে এক ছুটে ফটকের বাইরে চলে গেলো।হরিরও যে হাসি পাইনি তা নয়, তবে হাসতে গিয়েই মুখ ফিরিয়ে দেখলো দোতালার জানালায় ইন্দ্রজিৎ বাবু–তাকেই যেন ইশারা করে ডাকছেন। হরি তৎক্ষণাৎ দোতালায় ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকে দেখলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর হাতে একটা একহাত প্রমাণ কাঁচের পুতুল। পুতুলটা দেখেই হরির ভেতরে যেন একটা রহস্যের স্রোত বয়ে যেতে লাগলো, সে মনে মনে ভাবলো, আরে! এ তো কয়েকদিন আগে অন্ধকারে বাগানের মধ্যে দেখা সেই ছায়ামূর্তিটারই অবিকল মূর্ত্ত প্রতীক–একদম হুবহু মিল। হরিকে দেখে ইন্দ্রজিৎ বাবু পুতুলটা একটা কালো কাপড়ে জড়িয়ে রেখে দিলেন আলমারীর ভেতরে। পুতুলটা দেখে হরির যে কোনোপ্রকার ভাবান্তর হতে পারে–তা একবারও মনে হলো না ইন্দ্রজিৎ বাবুর। তারপর হরির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,”হরি, আজ সন্ধ্যা বেলা রমেনবাবু আসবে,বুঝলি?” কথাগুলো শুনে মনে হলো আজ রমেন বাবুর এখানে আসার যেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে।
হরি কিছু একটা জিজ্ঞাসা করবে ভাবছিলো কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারলো না।মনে মনে একটা আতঙ্ক মিশ্রিত উদ্বেগ নিয়েই সে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলো।
সন্ধ্যাবেলা যথারীতি রমেন বাবু এসে হাজির হলেন। ঘড়িতে তখন সাতটা ছুঁই ছুঁই। রমেন বাবুর কাঁধে দেখা গেল একটা শান্তিনিকেতন মার্কা সাইডব্যাগ আর ডান হাতে একটা চটের বড়থলে। থলেটার মধ্যে যে ভারী কোনো জিনিস আছে, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। গেট থেকে একটু দূরে রিক্সা থেকে নেমে এতক্ষণ হেঁটে হেঁটে আসছিলেন। গেটের দরজায় এসে কড়া নাড়লেন —-হরি তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে তাকে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে এলো। রমেনবাবু বারান্দায় পা দিয়েই মনে হয় ইন্দ্রজিৎ বাবুর খোঁজ নিলেন, হরি হাত তুলে রমেন বাবুকে দোতালায় উঠে যাবার ইশারা করলো। রমেনবাবুও আর কোনো কথা না বলে সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে গেলেন দোতালার বারান্দায়। ইন্দ্রজিৎ বাবু যেন এতক্ষণ তাঁরই অপেক্ষা করছিলেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। রমেনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে সোজা ঢুকে গেলেন তাঁর বেডরুমে। তারপর সশব্দে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের ভেতর থেকে দু’জনেরই চাপা গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
নিশ্চয় এমন কোনো গোপন আলোচনা, যা সাবধানতা অবলম্বন না করে আলোচনা করা যায় না।
মোটামুটি ঘন্টা দুয়েকপর ইন্দ্রজিৎ বাবুকে দেখা গেল দরজা খুলে বাইরে আসতে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে একদম হরির ঘরে এসে প্রবেশ করলেন। হরি তখন সবেমাত্র রান্নার কাজ শেষ করে –কার যেন একটা চিঠি পড়তে আরম্ভ করেছে। ইন্দ্রজিৎ বাবুকে ঢুকতে দেখেই হরি তক্তাপোষ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সসম্ভ্রমে বললো,”আসুন বাবু আসুন।” বলেই সে চিঠি খানা বিছানার নীচে গুঁজে রাখলো। ইন্দ্রজিৎ বাবু বললেন,”কিরে কি পড়ছিলি?চিঠি নাকি? কার চিঠি?”
হরি ঘাড় নাড়িয়ে যা বললো, তা অনেকটা এইরকম যে– তার স্ত্রী তাকে চিঠিতে একবার গ্রামের বাড়িতে দিন চারেকের জন্য যেতে লিখেছে। এভাবেই মাঝে মাঝে হরির চিঠি আসতো, আর চিঠি এলেই হরির কমসে কম দু/তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর হতো। কারণ মাঝে মাঝে হরির অনুপস্থিতিটা ইন্দরজিৎবাবুর বড় কাজে লেগে যেত। ইন্দ্রজিৎবাবু এবারও তাই হরির যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে দিলেন এবং উপরের ঘরে রাতের খাবার পৌঁছে দেওয়ার বরাত দিয়ে ধীরে ধীরে হরির ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠে গেলেন দোতালায়।
যাই হোক রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে রমেনবাবুকে বন্ধ তিনটে ঘরের একটা খুলে দেওয়া হলো। এখানে এলে এই ঘরেই তিনি প্রত্যেকবার রাত কাটান। অতএব, তিনি কোনো অস্বস্তি বোধ করলেন না। এবার বলি রমেন পুরকায়স্থের এ বাড়িতে মাঝে মাঝে আসার কারণটা—ভদ্রলোক প্রচণ্ড বিষয়ী তাই পেনশন ছাড়াও দু’পয়সা উপরি কামাতে তিনি অনেক কিছুরই দালালী করে থাকেন। প্রয়োজনে কাস্টমারের বাড়িতেও অর্ডার মতো মাল পৌঁছে দেন। এমনকি তিনি কাজের লোকও মফস্বল বা গ্রাম থেকে জোগাড় করে দিতে পারেন।ইন্দ্রজিৎ বাবুকে তিনি মাঝে মাঝেই ব্যাঙ, সাপ, গিরগিটি, গিনিপিগ, খরগোশ ইত্যাদি প্রাণী কাঁচের জারে পুরে এনে দিতেন, তাছাড়া দামী দামী দেশী বিদেশী গ্রন্থ তো আছেই। সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসটি তিনি অত্যন্ত গোপনে গভীর রাতে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসতেন–তা হলো বাচ্চা ছেলে বা মেয়ের লাশ।এরজন্য অবশ্য মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন ইন্দ্রজিৎ বাবুর কাছ থেকে। এই কারণেই এবাড়িতে রমেন বাবুর এতো খাতির যত্ন। রমেন বাবু লোকটা যে একটা বাস্তুঘুঘু তা তার হাবভাবেই বোঝা যায়।
যাইহোক, রমেনবাবু দরজা বন্ধ করে রুমের নাইটল্যাম্পটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লেন। অনেকটা রাস্তা জার্ণি করে এসেছেন। শুয়ে শুয়ে কি যেন ভাবছেন।ঘড়ির ঘন্টা জানান দিলো রাত এগারটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। চারদিকে একটা জমাট নিস্তব্ধতা বাড়িটাকে যেন চেপে ধরে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন প্রেতপুরী,বাগানের ঘন অন্ধকারে যেন অসংখ্য অশরীরী এসে দাঁড়িয়েছে, তাদের নিঃশ্বাসের শব্দে সাড়া বাড়িটা যেন দুলছে। হঠাৎ কিসের যেন একটা আওয়াজে রমেন বাবুর ঘুম ভেঙে গেলো। জলের বোতল থেকে একটু জল খেয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন শব্দটা কিসের?এর আগেও এ বাড়িতে তিনি রাত্রিবাস করেছেন। রাতে অনেক অস্বাভাবিক শব্দই তার কানে এসেছে; তবে আজকের শব্দটা যেন একটু আলাদা—তিনি কান খাড়া করে শুনতে লাগলেন।মনে হলো কেউ যেন সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে ভারী ভারী পা ফেলে। এবার তিনি উঠে দরজার পাল্লাদুটো একটু ফাঁক করে যা দেখলেন —তাতে তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা বরফের মতো ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতে লাগলো—তিনি দেখলেন একটা আপাদমস্তক বোরখা পরা ছায়ামূর্তি বারান্দার অন্ধকার পেরিয়ে ল্যাবেরেটরি রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো। তিনি চিৎকার করতে যেতেই বুঝলেন তাঁর গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। তবুও তিনি চোখ সরালেন না। অবশেষে দেখলেন সেই ছায়ামূর্তি যেন দরজায় মিলিয়ে গেলো। তারপর সারারাত তিনি দুইচোখের পাতা এক করতে পারলেন না,অর্থাৎ সারারাত একরকম না ঘুমিয়েই কাটালেন।পরদিন সকাল বেলা চা খেতে খেতে ইন্দ্রজিৎ বাবুকে ঘটনাটা জানালেন–ইন্দ্রজিৎ বাবু ঘটনাটা রমেনবাবুর হেলুসিনেশন্ বলে উড়িয়ে দিলেও তিনি নিজে জানেন এ ঘটনার সূত্রপাত কোথায়? রমেন বাবুও নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলেন ইন্দ্রজিৎ বাবুর রাস্তা ধরেই। একটু পর দেখা গেলো রমেন বাবু বাড়ির ফটক পেরিয়ে তাঁর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন।
এই ঘটনার প্রায় সাতদিন পর ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে চারদিনের জন্য ছুটিতে তার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। গজা এই চারদিন হোটেল থেকে তাঁর জন্য দিনে ও রাতে খাবার নিয়ে আসবে, তেমন কথা হয়েছে গজার সঙ্গে হরির।
পরের দিন গজা রাতের খাবার পৌঁছে দেওয়ার পর ইন্দ্রজিৎ বাবু যেন কোনো এক আগন্তুকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাতের খাবার পর্ব যেন-তেন প্রকারে সমাধা করলেন। রাত যখন বেশ গভীর হয়ে এলো –ওয়াল ক্লক আরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলো রাত একটা, তখন গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা অ্যাম্বাস্যাডার–ইন্দ্রজিৎ বাবু গাড়ির শব্দ শুনেই গেটের দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে ঢুকলো রমেন পুরকায়স্থ সঙ্গে ছোট্ট একটা চার পাঁচ বছরের মেয়ে। মেয়েটির গায়ে শতছিন্ন একটা ময়লা ফ্রক ও পায়জামা গোছের কিছু একটা। তাকে প্রচণ্ড ভয় দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে –তা বোঝা গেল তার চোখে মূখে একটা আতঙ্কের আস্তরণ অনুভব করে। গাড়িটা গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে।মেয়েটাকে নিয়ে রমেন ও ইন্দ্রজিৎ বাবু একদম দোতালায় ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকে গেলো। ল্যাবেরেটরির দরজা বন্ধ হলো।ইন্দ্রজিৎ বাবু মেয়েটার ডানহাতে কোকেন জাতীয় চেতনা নাশক কোনো ইঞ্জেকশন্ প্রয়োগ করে মেয়েটিকে টেবিলের উপর শুইয়ে দিলেন।আবার দরজা খুলে গেল, ততক্ষণে রমেন পুরকায়স্থ তার পাওনা বুঝে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যেতে লাগলো সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ বাবু। তাদের দু’জনের চোখেই দেখা যাচ্ছিল হিংস্রতা। রমেন বাবু গাড়িতে চাপলেন ও ইন্দ্রজিৎ বাবুকে হাত ইশারা করলেন, ইন্দ্রজিৎ বাবু তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতেই গাড়িটা চোখের নিমেষে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।ইন্দ্রজিৎ বাবু গেটটা ভালো ভাবে বন্ধ করে উঠে এলেন বারান্দায়। তারপর গ্রাউন্ডফ্লোরর দরজায় তালা লাগিয়ে উঠে গেলেন দোতালায়। ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। দেখলেন মেয়েটা টেবিলের উপর ততক্ষণে সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এবার এগিয়ে গেলেন আলমারীর দিকে, কালোকাপড়ে মোড়া সেই পুতুলটা বার করে নিয়ে এলেন এবং সেই পঞ্চকোণের ছবিটা। তারপর ওই দুটোকে সাজিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। হুইস্কির বোতল খুলে সমস্তটায় ঢেলে নিলেন গলায়—সারাঘর অন্ধকার কেবলমাত্র একটা মোমবাতি জ্বলছে টিমটিম করে, সারাঘরে কারা যেন ফিসফিস করে কথা কয়ছে—হঠাৎ পঞ্চকোণটা রক্তের মতো লাল হয়ে উঠলো–পুতূলের পেছনে এসে দাঁড়ালো আর এক ছায়া মূর্তি তার হাতে জলন্ত লৌহশলাকা। গোটা বাড়িটা এখন প্রেতলোকের চাদর জড়িয়ে যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে–ইন্দ্রজিৎ বাবু টলতে টলতে হাতে তুলে নিলেন শাণিত ছুরি তারপর টেবিলের উপর শায়িত উলঙ্গ অচৈতন্য ছোট্ট মেয়েটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। হঠাৎ এক সময় হিংস্র শ্বাপদের মতো বুক চিরে বার করে নিয়ে এলেন একটা মাংসপিন্ড—আবছা আলোয় দেখা গেলো মাংসপিণ্ডটা নড়ছে –ওটা হৎপিন্ড তখনও ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরিয়ে আসছে ওটা থেকে।মেয়েটার বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে আর সেই রক্তপান করে চলেছে সেই ছায়ামূর্তির সঙ্গে আরো অসংখ্য ছায়া মূর্তি। আজ এ বাড়িতে যেন শুরু হয়েছে প্রেতপার্বণ। অবশেষে হৃৎপিণ্ডটাও ইন্দ্রজিৎ বাবু তুলে দিলেন ঐ ছায়ামূর্তির হাতে। ছায়ামূর্তি সেই হৃৎপিণ্ড যেন লুকিয়ে নিলো নিজের ছায়াশরীরে। ঠিক তখনই বাইরে শোনা গেল প্রচণ্ড ঝড় ও বজ্রপাতের আওয়াজ। ঝড়ের দাপটে জানালার একটা পাল্লা খুলে যেতেই বিদ্যূতের একটা ঝলকানি জানালা দিয়ে ঢুকে মিলিয়ে গেলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর বুকে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন মেঝের উপর। সময় ততক্ষণে গড়িয়ে গেছে অনেকটাই। হঠাৎ ইন্দ্রজিৎ বাবুর জ্ঞান ফিরতেই তিনি দেখলেন সেই ঘরে পঞ্চকোণের ছবি এবং সেই পুতুলটা উধাও হয়ে গেছে। পরিবর্তে সেখানে পড়ে রয়েছে ইংরাজীর ওয়াই আকৃতির একটা রুপোর দণ্ড এবং একটা কালো চামড়ায় মোড়া বই। তিনি সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝতে পারলেন। রুপোর দন্ড ও চামড়ায় মোড়া বইটা তুলে রাখলেন আলমারীর ভেতরে গোপন একটা জায়গায়। হঠাৎ তার নজরে পড়লো মেয়েটার লাশ। লাশটা দু’হাতে তুলে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন একদম গ্রাউন্ডফ্লোরে তখনও চলছে ঝড় ও জলের তান্ডব। ইন্দ্রজিৎ বাবু অনেক কষ্টে বাগানের এক কোণে গর্ত খুঁড়ে নরম মাটির একদম গভীরে পুঁতে ফেললেন লাশটাকে। তারপর সেখান থেকে অতি দ্রুত উঠে এলেন ল্যাবরেটরি রুমে। এসে দেখলেন কোথাও এক ফোঁটা রক্তের চিহ্নমাত্র নেই। চারদিক একদম আগের মতোই পরিস্কার। পরেরদিন সকালে ইন্দ্রজিৎ বাবু টের পেলেন যে তাঁর শরীরে যেন কি একটা অলৌকিক শক্তি এসে বাসা বেঁধেছে। আরও একটা ঘটনা তিনি সেদিনের পর থেকে লক্ষ্য করতে লাগলেন আর তা হলো স্যামসনকে নিয়ে। ইন্দ্রজিৎ বাবু প্রায়ই লক্ষ্য করতেন স্যামসন বাগানের সেই বিতর্কিত কোণটির এক পাশে চুপ করে বসে আছে আর কেউ যেন অদৃশ্য থেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।তারপর স্যামসনকে অধিকাংশ সময়েই চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হতো দোতালার বারান্দায়–ইন্দ্রজিৎ বাবু লক্ষ্য করলেন ধীরে ধীরে স্যামসনের মধ্যে যেন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই ফুরিয়ে আসছে।
দু’দিন পরেই হরি ফিরে এসে দেখলো তার মালিকের বয়সটা যেন হঠাৎই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অনেকটা কমে গিয়েছে- চোখ দু’টোতে একটা নীলচে আভা। হরি মনে মনে ভাবলো এমন চেহারা সে আগেতো কোনো দিন দেখেনি–হরির ঘটনাটা রহস্যময় বলেই মনে হতে লাগলো।
তারপর প্রায় একমাস কেটে গেছে এখন অবশ্য ল্যাবেরেটরি রুমটা তালা বন্ধই থাকে। ইন্দ্রজিৎ বাবু আর নীচে নামেন না বললেই চলে। ইন্দ্রজিৎ বাবু তাঁর সেই অলৌকিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সমস্ত প্রকার ইন্দ্রিয়জ সুখ উপভোগ করতে লাগলেন নিশুতি রাতের নির্জনতাকে কাজে লাগিয়ে। কিন্তু সেদিন রাত্রে ঘটলো একটা আশ্চর্য ঘটনা—ইন্দ্রজিৎ বাবু খাওয়া দাওয়া সেরে তার বিছানায় চোখ মুজে শুয়ে আছেন, হরি আছে তার নিজের ঘরে–রাত তখন বারোটার বেশী হবে না বোধহয়! এখন প্রায়ই গভীর রাত পর্যন্ত ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘুম আসেনা। উনি ঘুমের ঔষধ ব্যবহার করেন মদের সঙ্গে তবুও অনেকক্ষণ জেগে থাকেন—জেগে থাকেন বললে ভুল হবে, কে যেন তাকে জোড় করে জাগিয়ে রাখে। ইন্দ্রজিৎ বাবুকে একটা কৌতূহল পেয়ে বসলো–তিনি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে গেলেন ল্যাবরেটরি রুমের দরজায়। পকেট থেকে চাবি বার করে খুলে ফেললেন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা সেই ল্যাবেরেটরি রুমটা। রুমটা খুলতেই তার নাকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে ভেতরটা গুলিয়ে দিলো। তারপর তিনি সেই অন্ধকারে যা দেখলেন তা অত্যন্ত ভয়ংকর, তিনি দেখলেন সেই মেয়েটি শুয়ে আছে টেবিলের উপর —ইন্দ্রজিৎ বাবু কিছুক্ষণ সেখানেই স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ দ্রুত বাইরে বেরিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করেই তালাটা লাগিয়ে দিলেন। নিজের ঘরে দ্রুত ফিরে এসে দরজা বন্ধ করলেন। হঠাৎ তার চোখ পড়লো ঘরের এককোণে রাখা টেবিলের দিকে দেখলেন সেখানেও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই মেয়েটি, বুকটা একবারে হাঁ হয়ে আছে আর ফিং দিয়ে রক্ত ছুটছে, তিনি বেশীক্ষণ আর সেই দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না –একটা বিকট চিৎকার করে জ্ঞান হারালেন।
এদিকে হরি মনে হয় তাঁর চিৎকার শুনতে পেয়েছিলো–সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘরে ঢুকতেই দেখলো তার মালিক ইন্দ্রজিৎ বাবু মেঝের উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না হরি। একটু পর সে জলের বোতল থেকে জল নিয়ে ইন্দ্রজিৎ বাবুর চোখে মুখে ছেটাতেই মনে হলো তাঁর ঠোঁটগুলো যেন একটু একটু নড়ছে।তারপর আরও একঘন্টা কেটে গেলো–এবার যেন ইন্দ্রজিৎ বাবুর চোখদুটো একটু খুললো। সে রাতটা ঐ ভাবেই কাটলো। পরের দিন ইন্দ্রজিৎ বাবু একটু বেলার দিকে যথারীতি সুস্থ হয়ে উঠলেও ঘুণাক্ষরেেও কাল রাতের ঘটনা হরিকে জানালো না। হরিকে তিনি তার ঐ অবস্থার কারণ স্বরূপ একটা আদত মিথ্যা কথা বললেন। সেইদিনই দুপুরে টেলিফোনে ইন্দ্রজিৎ বাবু একটা সুসংবাদ পেলেন–তাঁর ছোটো ছেলের স্ত্রী দীর্ঘদিন পর সন্তানসম্ভবা হয়েছেন। ইন্দ্রজিৎ বাবুর আনন্দ আর ধরে না। এ সংবাদ বহু প্রতীক্ষিত।
আনন্দে বিহ্বল হয়ে ইন্দ্রজিৎ বাবু সেদিন বাইরে বেড়াতে গেলেন হরিকে সঙ্গে নিয়ে –শ্মশান ছাড়িয়ে খোলামাঠে দু’জনে অনেকক্ষণ গল্পগুজবে এত মশগুল রইলেন যে –কখন যে গুটি গুটি পায়ে সন্ধ্যা নেমেছে তা টেরই পেলেননা।হঠাৎ হরি বললো ,”বাবু, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলুন, ঐ দেখুন!মেঘ করেছে! এখুনি হয়তো ঝড় উঠবে।”
তারা বাড়ির দিকে হনহন করে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু বেশীদুর এগোতে পারলো না। শ্মশানের কাছাকাছি একটা পোড়ো বাড়ি ছিলো। অগত্যা তারা দু’জনে আশ্রয় নিলো ঐ বাড়িটার মধ্যে। চারদিকে ততক্ষণে শুরু হয়েছে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি ও ঝড়–থেকে থেকে বজ্রপাতের চোখরাঙানি। হরি তো ভয়ে একেবারে আধখানা হয়ে গেছে। কাছেই কোথাও একটা বাজ পড়ার শব্দে চমকে উঠলো দু’জনেই। হঠাৎ বিদ্যুতের আলোয় ইন্দ্রজিৎ বাবু দেখলেন সেই পোড়ো বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে যেন একটা ছোট্ট মেয়ে, ইন্দ্রজিৎ বাবু আবার ভালোভাবে নজর করে দেখতেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সেই ছায়াশরীর। তিনি ঘটনাটা ততক্ষণে বুঝে গেছেন। হরি কিন্তু কিছুই দেখতে পেলনা। সেদিন প্রায় অনেকটা রাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছিলো ইন্দ্রজিৎ বাবু ও হরিকে। ইন্দ্রজিৎ বাবুর মনে শান্তি নেই।দিনের পর দিন তার সেই অলৌকিক শক্তির অপব্যবহারের ফলে কোনো এক বিপরীত শক্তি তার শরীরকে যেন ক্রমশ দুর্বল করে তুলছে—এটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছিলেন। তাই চোখে মুখে একটা আতঙ্ক তাকে যেন গ্রাস করতে চাইছে।
একদিন সন্ধ্যা বেলা হরি কি যেন একটা কাজে বাগানে যেতেই চোখ পড়লো বাগানের এককোণে। দেখলো একটা ছোট্ট মেয়ে যেন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে একটু এগিয়ে যেতেই যা দেখলো তাতে হরির প্রাণপাখি উড়ে যাবার জোগাড়। দেখলো দু’হাত মতো একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে বড় আমগাছের নীচে আর তাকে সেই লিকলিকে হাড়ের আঙ্গুল নাড়িয়ে ডাকছে। হরি ভয়ে পিছতে পিছতে শুনতে পেলো একটা হাড়হিম করা চাপা হাসি। সে প্রায় ছুটেই সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলো সেদিন।
তারপর কেটে গেছে সাত সাতটা বছর। এখন আর এবাড়িতে রমেন বাবুও আসেন না। একদিন খবরের কাগজে একটা সংবাদ পাওয়া গেলো–সংবাদটা এইরকম যে গঙ্গা বক্ষে চলন্ত স্টীমার থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে এক ভদ্রলোক, পুলিশ অবশেষে তার দেহটি খুঁজে পায় ও তার পরিচয় ও জানতে পারে–ভদ্রলোক সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ল্যাবরেটরি আসিস্ট্যান্ট ছিলেন, পুলিশ আরও জানিয়েছে যে ঐ ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, ভদ্রলোকের নাম–রমেন পুরকায়স্থ। এখন হরিও আর এ বাড়িতে রাধুঁনির কাজ করে না। সে চরম ভয় পেয়ে কাজে ইস্তফা দিয়ে পালিয়েছে কাউকে কিছু না বলে।গ্রামের ছেলে গজাও কোথায় ভিনরাজ্যে ভালো বেতনের লোভে পাড়ি দিয়েছে ।আর স্যামসন?—একদিন রাতে স্যামসনের লাশ পাওয়া গেলো বাগানেরই একটা কোণে। স্যামসনের শরীর বেশ কিছুদিন ধরে খারাপ যাচ্ছিল। সে নাকি প্রতিদিন রাত্রে বাগানের দিকে চেয়ে থাকতো আর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তো। ইন্দ্রজিৎ বাবু এখন একদম একা, একটা চরম পরিণতির জন্য যেন অপেক্ষা করে আছেন। তাঁর কাছে এখন থাকে একজন বিহারী রাঁধুনি সেই-ই সব দেখাশোনা করে।ইন্দ্রজিৎ বাবুর ছোটো ছেলে অরিজিৎ-ই একদিন ফোন মারফৎ সবকিছু অবগত হয়ে ঐ বিহারী যুবকটির হাতে তার বাবার সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলো। সেও আজ প্রায় সাত বছর আগের কথা।
একদিন একটা বুলেরো গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাড়িটার গেটে। গাড়ি থেকে নামলো একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা মেয়ে তারই হাত ধরে নামলো একটি সুন্দরী যুবতী ও সৌম্যদর্শন এক যুবক। ঐ যুবকটি হলো অরিজিৎ, ইন্দ্রজিৎ বাবুর ছোটো ছেলে আর ঐ যুবতী হলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর ছোটো পুত্রবধূ ইশিতা। ঐ যে ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটি! ও হলো অরিজিৎ-এর একমাত্র কন্যা–“তৃষা”, অর্থাৎ ইন্দ্রজিৎ বাবুর নাতনি।ছেলে, বৌ আর নাতনিকে কয়েক দিনের জন্য কাছে পেয়ে –ইন্দ্রজিৎ বাবুর বাঁচার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠলো–কি আনন্দ! কি আনন্দ!
কিন্তু দুর্ঘটনাটা ঘটলো সেদিন বিকালে। অরিজিৎ ও ঈশিতা যখন ফুলের বাগিচার ধারে দাঁড়িয়ে গল্পগুজবে ও ঠাট্টা তামাশায় একবারে মশগুল। ততক্ষণে তৃষা গ্রাউন্ডফ্লোরর বারান্দার বাগানের দিকের গেটটা খুলে পৌঁছে গেছে বাগানের সেই কোনাটায়।
এদিকে অনেকক্ষণ তৃষার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ঈশিতার মনে সন্দেহের উদ্রেক হতেই ব্যাপারটা অরিজিৎকে জানালো। তৃষার নাম ধরে জোরে জোরে ওরা দু’জনেই ডাকতে লাগলো, কিন্তু কোনো সাড়া পেলনা। ইশিতা তো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে রীতিমতো। অরিজিৎ ও সেই বিহারী রাঁধুনি রামলাল ততক্ষণে তৃষার খোঁজ আরম্ভ করে দিয়েছে। খুঁজতে খুঁজতে দেখলো তৃষা পড়ে রয়েছে বাগানের একটা আমগাছের নীচে। সেখান থেকে অরিজিৎই কোলে করে নিয়ে আসে তৃষার অচৈতন্য দেহ। অরিজিৎ সঙ্গে সঙ্গে ডাঃ চৌধুরীকে ফোন করলো। আধঘন্টার ভেতরে ডাঃ চৌধুরী এসে তৃষাকে পরীক্ষা করে জানালো ভয়ের কিছু নেই। তৃষা বাগানে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে। একটু সাবধানে রাখলেই হবে এবং যাবার আগে ডাঃ চৌধুরী বললেন, “ওকে কোনো ভাবেই বাগানে যেতে দেবেন না যেন, কারণ ভয়ের উৎস ওখানেই কোনো জায়গায় লুকিয়ে রয়েছে।”
সেদিন রাত্রে অরিজিৎ ও ঈশিতা দু’জনেই দুই চোখের পাতা এক করেনি। পরেরদিন সকাল থেকেই অবশ্য তৃষা বেশ আগের মতোই চনমনে হয়ে উঠলো। হঠাৎ ছুটে সে ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘরে গিয়ে হাজির হলো ইন্দ্রজিৎ বাবু অবাক হয়ে তৃষাকে দেখতে লাগলেন, আর মনে মনে বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন,”হ্যাঁ এই তো সেই! -এই তো সেই! –এসেছে!– আবার ফিরে এসেছে।” ইন্দ্রজিৎ বাবু ইশারায় তৃষাকে কাছে ডেকে তৃষার বুক খুলে দেখলেন বুকের উপর একটা লম্বালম্বি কালো দাগ–কেউ যেন বহুদিন আগে ছুড়ি দিয়ে কেটেছিলো জায়গটা। ইন্দ্রজিৎ বাবু নিজের ভবিতব্য বুঝতে পারলেন।তিনি একটা সাদা কাগজে কি যেন লিখে বালিশের নীচে লুকিয়ে রাখলেন।
আর সেই অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনাটাও ঘটলো সেদিন সন্ধ্যাতেই। অরিজিৎ ও ঈশিতা যখন কিচেনে ঐ বিহারী রাঁধুনিটিকে কি যেন বিদেশী রান্না শেখাচ্ছিলো। হঠাৎ তাদের কানে একটা চাপা গোঙানির শব্দ এসে পৌছালো–তারা সকলেই ছুটে দোতালায় ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘরে ঢুকেই দেখলো সেই ভয়ংকর দৃশ্য–দেখলো তৃষা প্রচণ্ড প্রতিহিংসায় দুই হাত দিয়ে চেপে ধরেছে ইন্দ্রজিৎ বাবুর গলা, তৃষার সে কি ভয়ংকর মূর্তি মনে হচ্ছে এ যেন তৃষা নয় ওর দেহে প্রবেশ করেছে কোনো অশরীরী শক্তি চোখগুলো মণিহীন–তাদের পা যেন সেই সিমেন্টের মেঝেতে আটকে গেছে, তারা অসহায়ের মতো দেখতে লাগলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর মৃত্যু যন্ত্রণা– দুই কান,নাক আর কষ বেয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত। কিছুক্ষণ পর ইন্দ্রজিৎ বাবুর দেহটা নিথর হয়ে গেলো। তৃষার দেহ থেকে একটা নীলচে আলো হঠাৎ বেরিয়ে এসে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো তীরের ফলার মতো তারপর মিলিয়ে গেলো বাগানের অন্ধকারে। তারা দেখলো তৃষা ইন্দ্রজিৎ বাবুর বুকের উপর পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে।ঈশিতা তৃষাকে সঙ্গে সঙ্গে কোলে তুলে নিয়ে চোখে মুখে জলের ছিটে দিতেই তার জ্ঞান ফিরে এলো।অরিজিৎ কান্নায় ভেঙে পড়লো। হঠাৎ বালিশের নীচ থেকে ইন্দ্রজিৎ বাবুর লেখা চিঠিটা খুঁজে পেলো অরিজিৎ।অরিজিৎ চিঠিটা খুলে দেখলো তাতে লেখা রয়েছে–“পরীক্ষিত সত্য! জন্মান্তরে প্রতিহিংসা শরীর ধারণ করে। আমার মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই এ চিঠি লিখছি। এরপরে এ বাড়িতে তোমরা আর কেউ থেকো না। এ বাড়ি একটা জলন্ত অভিশাপ।—ইতি আশীর্বাদক,তোমাদের হতভাগ্য পিতা।”
সমস্ত ঘটনা গোপন করে ইন্দ্রজিৎ বাবুর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এ বাড়িতেই। তবে এই অনুষ্ঠানে ইন্দ্রজিৎ বাবুর বড়ছেলে শুভজিৎ অংশগ্রহণ করেনি, যদিও তার স্ত্রী, একছেলে ও দুইমেয়ে উপস্থিত ছিলো শেষপর্যন্ত।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এখন এই অভিশপ্ত বাড়িতে কোনো মানুষের আনাগোনা নেই।মহাকাল ধীরে ধীরে গ্রাস করে চলেছে এ বাড়ির অস্তিত্ব।অন্ধকার নামলেই শোনা যায় কালপেঁচা আর ঝিঁঝিঁর একটানা তীক্ষ্ণ ডাকের সঙ্গে অশরীরীদের হা হুতাশ।
এক অপূর্ব রোমহর্ষক গল্প
ধন্যবাদ